আওরঙ্গজেব কামাল : সত্য উদঘাটন মানেই সাংবাদিকের জীবনের ঝুঁকি কিন্তু নেই কোন সুরক্ষার ব্যবস্থা। সাংবাদিকরা সব সময় থাকে ঝুকিতে। নিজের অজান্তে কারো না কারো শত্রুতে পরিনত হয়ে যায়।যে কারনে সাংবাদিকের জীবনের নিরাপত্তার প্রয়োজন রয়েছে। জীবনের ঝুকি নিয়ে সাংবাদিকরা সব সময় কাজ করেথাকেন। তবুও দেশে গণমাধ্যমের যে উজ্জ্বল ভূমিকা, তার সঙ্গে সারাদেশের হাজার হাজার সাংবাদিকের ঘাম-শ্রম ও জীবনের ঝুঁকি জড়িত। কিন্তু সাংবাদিকদের নিয়ে রাষ্ট্র ভাবছে কম! রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে সাংবাদিকদের প্রতি সহযোগীতার অভাব ও অনিহা পরিণাক্ষত । বর্তমানে সাংবাদিক নির্যাতন
বেড়েছে। কমেছে স্বাধীন সাংবাদিকতা । বর্তমানে লক্ষ করা যায় জনপ্রতিনিধিদের ছত্রছায়ায়ও সাংবাদিক নির্যাতনের অসংখ্যা ঘটনা ঘটছে।আমার মতে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং স্বাধীন সাংবাদিকতার বিকাশে এসব ‘সাংবাদিক
হামলা-নির্যাতন’ বন্ধ করা খুবই জরুরি।এর দায়ীত্ব সরকার ও রাস্ট্রের। বর্তমান পরিসংখ্যান আঁতকে ওঠার মতো। গত দেড় যুগে ৫১ জন সাংবাদিক হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছেন ৫৬ হাজার বর্গকিলোমিটারের এই দেশটিতে।
সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যার ঘটনা থেকে শুরু করে সাংবাদিক হত্যাকান্ডের একটি ঘটনার সঠিক বিচার হয়নি। খবর সংগ্রহকারী সাংবাদিকরা নিজেরাই বর্তমানে খবরে পরিনত হচ্ছে। বর্তমানে প্রায় ২৭% মামলাই সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে। গত চার বছরে ৩৫৫ সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা। চার বছরে গ্রেপ্তার ৮৪ সাংবাদিক। আর বেশির ভাগ মামলার বাদী ক্ষমতাসীন দলের
সঙ্গে যুক্ত। যখন যে সরকার আসে তারা সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে প্রায় সময় লক্ষকরা যায়। দেশে সাংবাদিকরা পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বছরের পর বছর ধরে নির্যাতিত হচ্ছেন। দেশে সাংবাদিক নির্যাতনের পরিসংখ্যান দিনেদিনে বেড়েই চলছে। ভয়-ভীতি, হুমকি-ধামকি, মামলা-মোকদ্দমা, মারাত্মক শারীরিক নির্যাতনে জখম থেকে শুরু করে গুম কিংবা খুন নির্যাতনের এমন কোনো ধরন নেই যার শিকার হচ্ছেন না সাংবাদিকরা। কিন্তু সেই অনুপাতে সাংবাদিক নির্যাতনের
বিচার হচ্ছেনা। দেখা যাচ্ছে এই বিচারের অভাবেই সাংবাদিক হত্যা বা নির্যাতনের ঘটনা বারবার ঘটে চলছে। কষ্টের কথা হলে- সন্ত্রাসী হামলায় একের পর এক সাংবাদিক হত্যাকাণ্ডের শিকার হলেও সাংবাদিকদের নিরাপত্তায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নীরব ভূমিকা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আইনি জটিলতায় বিচারিক কার্যক্রমে ‘বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদে’। সাংবাদিক হত্যার ঘটনায় সুষ্ঠু
তদন্ত ও বিচার থেকে বঞ্চিত হওয়ায় সন্ত্রাসীদের ঔদ্ধত্য ক্রমশ বেড়েই চলেছে। অবিলম্বে সাংবাদিকদের ওপর হামলা, মামলা ও নির্যাতন বন্ধ করতে হবে। গভীর রাত পর্যন্ত ঘুমহীন কাজ করতে হয় অনেক সংবাদকর্মীর। অনেকটা নিশাচরের ভূমিকা তাদের। সাংবাদিকদের পারিবারিক জীবন বলতে কিছু নেই বললেই চলে।কিন্তু সাংবাদিকদের মূল্যায়ন সমাজে নেই। পাশাপাশি নিরাপত্তা ঝুঁকিতো রয়েছেই। সমাজের অনেক সাংবাদিক ত্যাগী, নির্লোভী ও সৎ। তারা মানবকল্যাণে,সমাজকল্যাণে নিয়োজিত রয়েছেন। এই দিকটিও সরকারকে আমলে নিতে হবে। সাংবাদিকদের ওপর হামলা ও হত্যা বন্ধ করা না গেলে সৎ, মেধাবী, যোগ্য, তথ্যপ্রযুক্তিতে সমৃদ্ধ উচ্চশিক্ষিত তরুণ-তরুণীরা এখন যে সংবাদপত্রেঢুকছেন, তারা নিরুৎসাহিত হবেন। এমনিতেই সাংবাদিকদের পেশাগত নিশ্চয়তা ও নিরাপত্তা নেই, তার ওপর যদি কর্তব্য পালন করতে গিয়ে তাদের জীবনের ঝুঁকি
বেড়ে যায় কিংবা তারা হামলা এবং হত্যার শিকার হন তাহলে কীভাবে সাংবাদিকতা পেশা বিকশিত ও প্রতিষ্ঠিত হবে? সাংবাদিকদের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে গণতন্ত্রকে সুসংহত করতে হলে
সাংবাদিকদের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিকল্প নেই। এই নিরাপত্তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। সরকারকে এসব হত্যাকান্ডের বিচারে অবশ্যই আন্তরিক ও কঠোর হতে হবে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, আমাদের দেশে কোনো
সময়ই সংবাদপত্রের অবাধ স্বাধীনতা ছিল না। কখনো সংবাদপত্রের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে সেন্সরশিপ, প্রণয়ন করা হয়েছে বিভিন্ন কালাকানুন। গণমাধ্যমের কার্যালয়ে পুলিশের মারমুখী অনুপ্রবেশ, কর্মরত সাংবাদিককে চোর-ডাকাতের মতো
আটক করার ঘটনা ঘটেছে অনেক। অধিকাংশ সংবাদপত্র এবং সাংবাদিকগণ সরকারের কর্মকান্ডকে সামনে তুলে ধরে প্রকারন্তে সরকারেরই কাজ করছে। তাহলে সাংবাদিকরা এভাবে হয়রানীর শিকার হবেন কেন? সবসময় দেখেছি বাংলাদেশে
গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নানা রকম বিধিনিষেধ মোকাবিলা করছে। ডিজিটাল যুগে এসে এখন পড়েছে আরো অনেক সমস্যায়। সাংবাদিকতার মান নিয়ে উঠেছে নানা বিধ প্রশ্ন। এছাড়া এক সাংবাদিক আর এক সাংবাদিককে মেনে নিতে নারাজ। বিশেষ করে
কতিপয় সিনিয়র সাংবাদিক জুনিয়র সাংবাদিকদের মেনে নিতে চায় না। তাদের নানা ভাবে হয়রানী করেন। প্রায় সময় সিনিয়র সাংবাদিকদের বলতে শুনি ‘ও কিসের সাংবাদিক ? ‘ও কোন মিডিয়ায় কাজ করে ? তারা নাকি অপ-সাংবাদিকতা বন্ধ করতে
বদ্ধ পরিকর। কিন্ত নিজেরাই সব সময় অপ সাংবাদিকতার মধ্যে থাকেন। যেন শিয়ালের মুরগী পালার মত। এখন আবার দেখি নিজের নামটি সঠিকভাবে লিখতে বা বানান উচ্চারণ করতে না পারলেও অনেকেই সাংবাদিক পারিচয় দেয়।তারা নিজেকে
বলেন ডিজিটাল সাংবাদিক। পড়া বা লিখার প্রয়োজন নেই। দেখতে ও বলতে পারলেই সাংবাদিক। তবে, তারা কেউ আবার সাংবাদিক শব্দটিও উচ্চারণ করতে পারেন না।বলেন, সম্বাদিক। কেউ বলেন, সাম্বাদিক। এদের গলায় ব্যাগ, কোমরে হরেক রঙের বাহারী পরিচয়পত্র, হাতে বুম ও গলায় মাইক্রো ফোন ঝুলিয় তাদের বেশিরভাগই নতুন মোটরসাইকেলে চষে বেড়ায় পুরো দ্যেশ ব্যাপী যেনো দেখার কেউ নেই। এদের বেশ-ভুষা দেখে দাপুটে সাংবাদিক মনে হলেও পরিচয়পত্র দেখলেই অবাগ হয়ে পরার মত অবস্থা। তাদের কারণে পেশাদার সাংবাদিকগণ রয়েছেন চরম বিপাকে।সাংবাদিকতা বা সাংবাদিক কাকে বলে এর নূন্যতম কাণ্ডজ্ঞান না থাকলেও নিজেদের সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে স্বার্থ হাসিল করার ধান্দায় প্রতারণার আশ্রয় নেয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভাড়ায় মটোরসাইকেল চালক, মুদির দোকানি,এমনকি মাদক ব্যবসায়ীরাও পিছিয়ে নেই সাংবাদিক পরিচয়ে দাপিয়ে বেরাতে। এরা সাংবাদিক সেজে মোটরসাইকেলে প্রেস ও সাংবাদিক লিখে বোকা বানাচ্ছেন বিভিন্ন মহলকে। এই সব ভূয়া সাংবাদিকের নানা অপকর্মের কারণে প্রকৃত পেশাদার সাংবাদিকদের ভাবমূর্তি এখন প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার উপক্রমহয়েছে। একশ্রেণীর এসব টাউট-বাটপারদের কারণে পেশাদার সাংবাদিকগণ পেশাগতদায়িত্ব পালন করতে গিয়ে প্রতিনিয়ত বিড়ম্বনার মুখে পড়ছে বলে জানিয়েছে মুলধারার সাংবাদিকরা ।আমাদের এ থেকে পরিত্রাণের প্রয়োজন। এটি ধারাবাহিক নিয়মে সাংবাদিকতা চর্চার প্রয়োজন। যেটা শুধু রাষ্ট্রে ও জনগনের কাজে আসবে। কিন্ত আমরা লক্ষ করছি সাংবাদিকদের মুখ্য উদ্দেশ্য হলো সাংবাদিকতাকে অবলম্বন করে জন-মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য ভূমিকা রাখা। সে কারণে গণমাধ্যমকে জনগণ
ভরসার শেষ ঠিকানা মনে করেন। বাংলাদেশে সাংবাদিকতার ইতিহাসে সাংবাদিকদের ওপর বিভিন্ন সময় চালানো হয় জেল-জুলুম, নির্যাতন, অত্যাচার ও নিপীড়ন। সাংবাদিক হত্যার ঘটনাও নতুন নয়। আইনি জটিলতাও মুক্ত সাংবাদিকতায় বাধা
সৃষ্টি করছে।এ পেশার মূল লক্ষ্য হলো মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করা। মানুষের কথা বলা। মানুষের সমস্যা, সমাজের নানা অসঙ্গতি অনিয়ম অবিচার তুলে ধরা। একজন ভালো সাংবাদিককে যেমন সাহসী হতে হয়- তেমনি সত্যনিষ্ঠ ও
নীতির প্রশ্নে আপসহীন এবং ন্যায়ের প্রশ্নে অবিচল থাকতে হয়। ঝুঁকি থাকলেও অনেকেই ভালোবাসার কারণে এ পেশাকে বেছে নেন এবং আজীবন সাংবাদিকতায় স্বতশ্চল থাকেন। যারা অকপট সততার সঙ্গে এ পেশায় সক্রিয় থাকেন তাদের এক
ধরনের আত্মতৃপ্তি থাকে। ভালো কাজের জন্য আনন্দ থাকে। একজন সাংবাদিকের কাজ সমাজের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরা। সে জন্য গণমাধ্যমকে সমাজের দর্পণ বলা হয়। এই দর্পণে প্রতিবিম্বিত হয় সমাজের প্রতিচিত্র। অন্যায়, অনিয়ম, নিগ্রহ,
শোষণ-বঞ্চনা ও অধিকার হরণের বিরুদ্ধে একজন সাংবাদিককে সোচ্চার থাকতে হয় সবসময়। চোখ রাঙানোকে গণ্য না করে নির্ভীক ও নিরলসভাবে কাজ করতে হয়। প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থার চিত্র প্রত্যক্ষ করতে হয়। মানুষের সমস্যার কথা তুলে ধরার দায়িত্ব পালন করতে হয়। অনেক বাধা বিপত্তির মধ্যে তাদের দিন যায়। ক্ষমতাধরদের রক্ত চক্ষু উপেক্ষা করে সাহসিকতার সঙ্গে এগিয়ে যেতে হয়। অভাব অনটনের ভেতর শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়াতে হয়। পরিশ্রম করতে হয় অনেক। সততা নীতি ও আদর্শ নিয়ে যারা সাংবাদিকতা করেন অর্থাভাব তাদের নিত্যসঙ্গী। টানাপড়েনের ভেতর দিয়ে তাদের চলতে হয়। সংসার চালানো তাদের জন্য বড় কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। দারিদ্রের ঘেরাটোপে বন্দি থেকে তাদের জীবন কাটাতে হয়। কিন্ত এখন এর ব্যতিক্রম চিত্রও আমরা দেখতে পাই। অযোগ্য অর্বাচীন কিছু মানুষের পদচারণায় কলঙ্কিত হতে দেখা যায় বাংলাদেশের সাংবাদিকতার গৌরবময়
জগৎ। কোনো মহৎ উদ্দেশ্য থেকে নয় অর্থ লিপ্সুতা থেকে এবং সমাজে প্রভাব তৈরি করার ইচ্ছে থেকে অনেকে এ পেশার সঙ্গে যুক্ত হন। ভুঁইফোড় সংবাদ মাধ্যমের সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে নানা ধান্ধাবাজি করে। নানারকম অপতৎপরতায়
লিপ্ত থাকে। বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে টার্গেট করে সংবাদ পরিবেশনের হুমকি দেয়। ভয় ভীতি প্রদর্শন করে দেদারসে অর্থ আদায় করে। খুব অল্পসময়ের মধ্যে এরা অর্থ সম্পদের মালিক হয়ে যায় এবং একই ধরনের কিছুসংখ্যক ব্যক্তি
মিলে গড়ে তোলে সাংবাদিক সিন্ডিকেট। এদের পড়াশোনা ও মেধার ঘাটতি থাকে।সাংবাদিকতার সঠিক সংজ্ঞাও এরা জানে না।এসব বন্ধ করতে হলে একত্রিত হতে হবে। সম্মিলিতভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলার প্রচেষ্টা চালাতে হবে। নিজেদের মধ্যে বিভাজন দূর করতে হবে। তা না হলে সমস্যা থেকেই যাবে।
আওরঙ্গজেব কামাল
লেখক ও গবেষক.
সভাপতি : ঢাকা প্রেস ক্লাব